জিডিসি: বিশ্ব ডায়াসপোরার ঐক্যের নতুন মঞ্চ

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০ কোটির বেশি মানুষ জন্মভূমির বাইরে অভিবাসী হিসেবে বসবাস করছেন, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (IOM) এমন তথ্য জানিয়েছে। এই অভিবাসীরা কেউ শরণার্থী, কেউ পেশাজীবী, শিক্ষার্থী, শ্রমিক বা ব্যবসায়ী। তাঁরা সবাই এক কথায় ডায়াসপোরা—যারা ভৌগোলিকভাবে দূরে থাকলেও শিকড়ের টান ভুলে যেতে পারেন না।

বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো—ভারত, চীন, রাশিয়া, মেক্সিকো—যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ বিদেশে অবস্থান করছে। এই বিশাল প্রবাসী জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সমস্যা, সংকট ও আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে যান, বিশেষ করে প্রবাসে জন্ম নেওয়া প্রজন্মগুলো। অনেকে বৈধতা পান না, কেউ কেউ হয়রানি ও শোষণের শিকার হন, আবার অনেকেই মাতৃভূমির সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেন।

🧩 ডায়াসপোরা সংগঠন: আত্মপরিচয় ও ঐক্যের খোঁজ

প্রবাসীরা বিশ্বের নানা দেশে নানা ধরণের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক ভিত্তিতে সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এগুলো তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে, সাংস্কৃতিক বন্ধন বজায় রাখে এবং বিপদের সময় পাশে দাঁড়ানোর প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে।

তবে এসব সংগঠনের কার্যক্রম অনেক সময় বিচ্ছিন্ন, প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীন এবং বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে।

🌐 গ্লোবাল ডায়াসপোরা কনফেডারেশন (GDC): এক ছাতার নিচে বিশ্ব ডায়াসপোরা

এই প্রেক্ষাপটেই ২০২০ সালে মহামারির সময় জন্ম নেয় গ্লোবাল ডায়াসপোরা কনফেডারেশন (GDC)—একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক, যার লক্ষ্য বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ২০ হাজার ডায়াসপোরা সংগঠনকে একত্রিত করা।

✅ জিডিসির মূল উদ্দেশ্য:

  1. ডায়াসপোরা সংগঠনগুলোকে সংযুক্ত ও ঐক্যবদ্ধ করা
  2. নেতৃত্ব গড়ে তোলা এবং প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর তৈরি করা
  3. টেকসই উন্নয়ন ও সামাজিক প্রভাব নিশ্চিত করতে সহায়তা

এই উদ্যোগকে IOM (জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা) সক্রিয়ভাবে সমর্থন, প্রশিক্ষণ এবং অর্থায়ন করছে।

🛠️ গঠন ও কার্যক্রম

  • প্রথম ভার্চুয়াল সভা হয় ২০২০ সালের এপ্রিলে
  • জুলাইতেই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে
  • প্রথম বছরে ২৩০টি সংগঠন এবং ১,৪০০ স্বেচ্ছাসেবক যুক্ত হয়
  • জিডিসির বোর্ডে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার প্রতিনিধিত্ব রয়েছে
  • চীনা বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক পিটার কোয়ক এর চেয়ারম্যান

🧑‍🎓 গ্লোবাল ডায়াসপোরা একাডেমি (GDA)

ডায়াসপোরা নেতাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য জিডিসি প্রতিষ্ঠা করে ‘গ্লোবাল ডায়াসপোরা একাডেমি’, যেখানে অনলাইন কোর্স, লিডারশিপ ট্রেনিং এবং অংশীদারিত্বভিত্তিক কর্মশালার আয়োজন করা হয়।

২০২৫ সালের জুনে অনুষ্ঠিত ‘ডায়াসপোরা অ্যাসেনশিয়ালস’ প্রোগ্রামে অর্ধশতাধিক নেতা অংশ নেন, যাঁরা প্রশিক্ষণ নেন প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, অর্থায়ন, নেটওয়ার্কিংসহ নানা বিষয়ে।

🤝 ইউক্রেন যুদ্ধ ও মানবিক সাড়া

২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের সময় জিডিসি গঠন করে ‘গ্লোবাল ডায়াসপোরা হিউম্যানিটারিয়ান হাব’, যার মাধ্যমে বিভিন্ন ডায়াসপোরা সংগঠন একসঙ্গে মানবিক সহায়তায় অংশ নেয়।

🇧🇩 বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ কোথায়?

দুঃখজনকভাবে এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ এই বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশি ডায়াসপোরা সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। ব্যতিক্রম মাত্র একটি—যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ‘আগামী ইনক’, যারা জিডিসির সদস্যপদ পেয়েছে।

সংগঠনটির অন্যতম কর্ণধার সাবির মজুমদার জানালেন, তিনি বর্তমানে জিডিসি ফান্ড রেইজিং টিমের প্রধান এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ট্রেনিং কর্মসূচির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর মতে, “এমন একটি প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ শুধু প্রয়োজন নয়, সম্মানজনকও। কিন্তু আমাদের পক্ষ থেকে এখনো কৌশলগত অংশীদারত্বের চিন্তা গড়ে ওঠেনি।”

🌏 বৈচিত্র্যে ঐক্যের বার্তা

জিডিসি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ডায়াসপোরা শুধু রেমিট্যান্সের উৎস নয়, বরং তারা সাংস্কৃতিক দূত, নৈতিক শক্তি ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের সম্ভাবনাময় অংশ। বিশ্বজুড়ে যখন জাতিগত বিভাজন ও বৈষম্য বাড়ছে, তখন এই কনফেডারেশন একটি নতুন আশার আলো হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশি ডায়াসপোরা সংগঠনগুলোর এখন সময় এসেছে এই বিশ্বমঞ্চে সক্রিয়ভাবে নিজেদের অবস্থান জানানো, সংযুক্ত হওয়া এবং বৈশ্বিক উন্নয়নে অংশ নেওয়ার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *